top of page
Writer's pictureGeetali Sen

আলাদা পৃথিবী - পর্ব ৬



ষষ্ঠ পর্ব (অন্তিম পর্ব)

সেদিন সন্ধ্যে থেকেই বেশ ঝিরঝির করে হাওয়া দিচ্ছিল। আর দু’এক ফোঁটা বৃষ্টিও পড়ছিল টিপটিপ করে। তাড়াতাড়ি করে খেয়ে নিয়ে যে যার বিছানায় গিয়ে বোধহয় একটু বেশিই ঘুমিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ সুমিতা ঘুম আর জাগরণের মাঝে অস্পষ্ট এক ডাক শুনতে পেল। এমনই কি হয় নিশির ডাক? শুয়ে শুয়েই কেঁপে উঠল সুমিতা! এবার কি তবে নিশির মতই ডেকে নিয়ে যাবে রিমঝিমকে? তবুও যথাসম্ভব চোখের পাতা এঁটে নিশ্বাস বন্ধ রাখল। ততক্ষণে আর একবার ডেকে দিযেছে টুপটুপ। রিমঝিম চোখ কচলে বিছানার উপর উঠে বসেছে। মায়ের দিকে এক পলক তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে,

-দাঁড়া আসছি।

তারপর খাট থেকে নেমে পুতুলের জিনিসপত্র নিয়ে চলে যায় বন্ধুর সাথে খেলতে। ওরা চলে যাওয়ার পর আরও দশ মিনিট একইভাবে শুয়ে থাকে সুমিতা। না, কোনরকম তাড়াহুড়ো করা চলবে না। একটু এদিক ওদিক হয়ে গেলেই ব্যর্থ হয়ে যাবে সমস্ত কিছু। তা হতে দেওয়া যায় না কিছুতেই। রিমঝিম আর টুপটুপদের ফ্ল্যাটদুটি দুটো আলাদা টাওয়ারে। এমনিতে যাওয়া আসা করা বেশ কিছু সময়ের ব্যাপার। কিন্তু ওদের দুটো ফ্ল্যাটই পাশাপাশি দুই টাওয়ারের পিছন দিকে আর সেগুলির মাঝে ওই কানেক্টর। ব্যস, এখান দিয়ে ছুটে ছুটেই তো দুই বাড়ির বাচ্চাদের সাথে সাথে বড়দেরও বন্ধুত্ব এত বেশি। তাই বেশ কিছুক্ষণ পর পা টিপে টিপে কানেক্টরের দরজা খুলে মিনতীর দরজায় গিয়ে মৃদু টোকা দেয় সুমিতা। সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে বেরিয়ে আসে মিনতী।

-একী! জেগেই ছিলে?

বলেই বোঝে সন্তানহারা মায়ের কাছে এ প্রশ্ন অবান্তর।

দুজনে পায়ে পায়ে এসে দাঁড়ায় কার্টনের পাশে। তন্ময়ও এসেছে সাথে। কত কতদিন পরে আজ সত্যিই কি সে তার সন্তানকে দেখতে পাবে? শুনতে পাবে তার গলার স্বর? কার্টনের ওদিকে দাঁড়িয়ে থাকা প্রবাল ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ইশারায সবাইকে চুপ থাকতে বলে। কিন্তু ওই ইশারা সুমিতা ছাড়া আর দেখবে কে? মিনতী আর তন্ময় তো ততক্ষণে পাথরের মূর্তি। কত দিনের ক্ষিদে নিয়ে তারা আবার দেখছে তাদের মেয়ের পুতুল গোছানো, খেলনাপাতি খেলা। শুনছে সেই মিষ্টি গলার রিনরিনে স্বর। কত সহজে দুটি শিশু পরস্পরের সাহচর্যে ডুবে গেছে খেলার জগতে। মৃত্যুও পারেনি তাদের আলাদা করতে। একেই বোধহয় বলে শৈশব! খেলতে খেলতে রিমঝিম জিজ্ঞেস করে,

-এ কদিন তুই আসিস নি কেন রে টুপটুপ?

-কী করে আসব? মা তো তাহলে খুব কাঁদত।

রিমঝিম অবাক হয়,

-কেন, কাম্মা কাঁদবে কেন?

এবার নির্বিকার ভাবে পুতুলকে কাপড় পরানো হতে হতে ওই তুলোর মৎ আবছায়ার ভিতর থেকে আওয়াজ আসে,

-কাম্মার কাছে শুনেছে যে আমি তোর সাথে খেলি। আমকে দেখতে না পেলে মা কত কাঁদে না? দ্যাখ সবাই পিছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে যে।

চমকে ফিরে তাকিয়ে রিমঝিম অস্ফুট চীৎকার করে ওঠে। দাঁড়িয়ে থাকা বড়দের রক্ত শিরশিরানি হয়ে পা থেকে হঠাৎ মাথায় উঠে আসে। মিনতীকে টলতে দেখে মুহূর্তের মধ্যে তাকে দুদিক থেকে ধরে ফেলে সুমিতা আর তন্ময়। সুমিতার সমস্ত নিষেধকে আগ্রহ্য করে অজ্ঞান হয়ে যেতে যেতেও মিনতী দু’হাত সামনে ছড়িয়ে বলতে থাকে,

-ও টুপটুপ, সোনা আমার, এই তো তুই এসেছিস। আমার কাছে কেন আসিসনি মা? আমি যে তোর জন্য সারাদিন কাঁদি। আমি আর পারছি না। আয় মা আমার কাছে আয়। আমার কাছে আয়।

আর বলতে পারে না। আচমকা ঢলে পড়ে চুপ করে যায়। তবে ততক্ষণে যা দেখার দেখে নিয়েছে সুমিতা। তুলোর বলটা লাফাতে লাফাতে বেহুঁশ মিনতীর একেবারে বুকের কাছে এসে হারিয়ে যায়। প্রবাল আর তন্ময় দুজনে ধরাধরি করে মিনতিকে ঘরে শোওয়াতে গেলে ককিয়ে ওঠা রিমঝিমকে বুকের মধ্যে চেপে নিয়ে চুপ করে বসে থাকে সুমিতা। রিমঝিমের কথা ভেবে মনটা হাহাকার করে উঠলেও মিনতীর কথা ভেবে মনটা আনন্দে ভরে যায়। টুপটুপ আর আসবে না রিমঝিমের কাছে এটা বেশ বুঝতে পেরেছে সুমিতা। তাই আগের বারের মত রিমঝিমে আবার ডিপ্রেশনে তলিয়ে যাবে নাকি? এই ভাবনায় অস্থির হয়ে ওঠে সে। অনেক ভেবে পরের দিনই প্রবালকে বলে ছেলেমেয়েদের নিয়ে তাকে হাজারিবাগে বাবা-মায়ের কাছে রেখে আসতে। ঝমঝম তো ছোট, আর রিমঝিমের পরীক্ষার রেজাল্ট খরাপ হলেও তাকে বকাঝকা তো দূরের কথা আদর দিয়ে অন্যদিকে মনটা ফেরাবার চেষ্টা যেটুকু করা যায় ....... করতেই হবে। ভোলানো তো যাবে না কখনোই, শুধু এইভাবেই রাখতে হবে আর থাকতেও হবে। ভেবেছিল কত দিনই না কাটাবে একসাথে। তাই মেযেদুটোর নামও রেখেছিল মিলিয়ে সংযুক্তা আর সংপৃক্তা। এখানে আসর পরই তো জন্মেছিল ওরা। কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস! না: এখন ভাবতে হবে রিমঝিমকে নিয়েই। ওর কচি মনের উপর এর মধ্যেই অনেক চাপ পড়ে গেছে। এবার তাই খুঁজতে হবে অন্য বাড়ি। প্রবাল যেন তখনই আনতে যায় তাদের। তবে যাবার আগে মিনতীকে সে সেদিন যা দেখেছিল তাও বলে যেতে হবে। যদি ফিরে আসে টুপটুপ ......... এত কিছুর পরেও যদি ওদের দু:খের দিন শেষ হয়.........

প্রায় কুড়ি বছর পর ইসরোর মহাকাশ বিজ্ঞানী সংযুক্তা মিত্র অধস্তন সদ্য কাজে যোগদান করা ইঞ্জিনিয়ারদের মধ্যে একজনকে ডেকে পাঠান। তার সাথে এই মেয়েটি দেখা করতে আসে। যদিও সংযুক্তা অর্থাৎ রিমঝিমের জুনিয়রদের সবার নাম এখনও জানা হয় নি। তবু এই মেয়েটিকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে দিতে কি এক সন্দেহে থেমে যায় সংযুক্তা। প্রশ্ন করে,

-তুমি বাঙালী?

-ইয়েস ম্যাম।

-নাম?

নিজের বাবা- মায়ের পরিচয় দিয়ে বলে,

-আমার নাম সংপৃক্তা ঘোষ। মা আমাকে আপনার সাথে পরিচয় করতে বলেছিলেন।

এত বছরের আস্তরণ ভেদ করে এক অদ্ভুত শিরশিরানিতে কেঁপে ওঠে সংযুক্তা। ও: কাম্মা তাহলে নামটাও পাল্টায়নি? যাতে তাকে চেনা যায়। স্পষ্ট যেন আজও শুনতে পায় সেই ডাক,

-রিমঝিম। রিমমম। ঝিমমম।

ইচ্ছে হল ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,

-কোথায় ছিলি রে টুপটুপ এতদিন? জানিস আমি কত কেঁদেছি তোর জন্য? নতুন বাড়িতে এসেও আমি তোকে ভুলতে পারিনি রে।

কিন্তু সে সব কিছুই হয় না। সংযুক্তা নিজের পদমর্যাদার কথা ভুলে গিয়ে খুব আন্তরিকভাবে মেয়েটির কাঁধে হাত রেখে বলে,

-সংপৃক্তা? বা: খুব ভালো নাম। আর ডাকনাম কি হুঁ? টুপটুপ?

-হ্যাঁ। কিন্তু আপনি কী করে ......

রিমঝিম ততক্ষণে তর চোখের ভিতর দিয়ে দৃষ্টি চালিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সেই চেনা ঝিলিকটা ....... চেনা ঝিলিকটা ......

13 views0 comments

Recent Posts

See All

Comments


bottom of page