তৃতীয় পর্ব
লাইট এন্ড সাউন্ডটা ওদের তেমন ভালো লাগল না । স্বস্তিক বলল,
-চল সাতু, তখন তো আমাদের নাজিমখানাটা সেভাবে দেখা হয়নি, দেখবি খোলা আছে কিনা?
-একদম একদম । এটাই বলতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু আবার অত সিঁড়ি ? বলেই হঠাৎ .......
-আচ্ছা করিডরের পাশের প্যাসেজ দিয়ে গেলে তো ...
- চ , চ।
কিন্তু নিজামখানায় পৌঁছাতেই একটা বড় চমক!
-একি! এ যে একেবারে সভা বসে গেছে !
অনেক অনেকক্ষণ ধরে আর বাক্যস্ফূর্তি ঘটে না দুই ভাইয়ের। এ তো এক বিশাল দরবার, তাও আবার দুইভাগে ভাগ করা! মাঝের অংশে সভা বসেছে। দু’দিক দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে মহলের শেষপ্রান্ত পর্যন্ত। সিঁড়ির শেষে দু’মানুষ সমান উঁচু দুটি জমকালো দরজা ভিতর দিকে অন্য্ কোন মহলের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এদিকে বিশাল বিশাল বাহারি থামগুলি মেঝে থেকে উঠে গেছে হলের ছাদ পর্যন্ত। এগুলির হাতির দাঁতের মত হলদেটে সাদা রঙ। সিঁড়ির ওপাশে পরপর সুসজ্জিত দরজা। তদের ভিতর থেকে কম বেশি বিভিন্ন ধরনের আলো ভিতরের মানুষজন এবং কর্মকাণ্ডের ইঙ্গিত বয়ে নিয়ে এসে রাঙিয়ে তুলেছে দরজাগুলির বাইরের অপরিসর টানা বারান্দাটি। উপরের খিলানগুলি ঢাকা নানা রঙের খড়খড়ি দিয়ে। মানানসই রঙের খড়খড়ি-নিয়ন্ত্রকগুলো ঝুলছে একদম নিচে পর্যন্ত। রক্তলাল জাজিমে ঢাকা পিছনের মঞ্চকেও ঘিরে আছে জাফরিকাটা বেশ কয়েকটা গবাক্ষ, আর সামনের অংশটাকে চারটে গম্বুজ তিনটে খিলানে ভাগ করে দিয়েছে।
একটা সময়ে মগ্নস্বরে সার্থক বলে ওঠে,
-দেখেছিস, এক্কেবারে যেন অরিজিন্যাল । ওপরটা তো ঘাড় উঁচু করে হাঁ করে তাকিয়ে দেখতে হচ্ছে রে! কেমন সুন্দর ঘন নকশার মাঝে মাঝে দারুন দারুন সব কি বলে যেন ঝাড়লন্ঠন ঝুলছে।
-আর দেখ, কিরকম আলোটা না! কেমন যেন .... কেমন যেন অন্যরকম ... অন্য পৃথিবীর মায়ার আলো। সারা সভাজুড়ে না?
-আরে! পেশোয়াদের পোশাক, জাঁকযমক কিছুই তো বাদ দেয়নি এরা। আবার সভাতে কত লোক দেখেছিস?
সম্মতি জানাতে খানিকটা হাসির সাথে আবেগ আর মজা নিয়ে স্বস্তিক বলে ওঠে,
-আহা! ওভাবে বলছিস কেন? বরং এভাবে বল – সর্বাপেক্ষা বৃহৎ এবং সুদৃশ্য ঝাড়বাতির নীচে জমকালো এক রাজকীয় সিংহাসনে আসীন মহামান্য পেশোয়া। বিশাল সুদৃশ্য গড়গড়ার নলটি তাঁর হস্তে ধৃত। ঘনসন্নিবিষ্ট আরামদায়ক উজ্জ্বলবর্ণের গদিগুলি রাজাসন ঘিরে যেন ফুলের ন্যায় প্রস্ফুটিত ....
সার্থকও একইভাবে সাথে সাথে শুরু করে,
-সভাকক্ষে মহামান্য পেশোয়ার দুইপার্শ্বে বিরাজিত পুরোহিত, মন্ত্রী ও সভাসদগন। তাঁদের আসন নির্দিষ্টকারক জাজিমই প্রত্যেকের পদমর্যাদার বিভাজিকা।
-এটাও তাহলে ঐ লাইট এন্ড সাউন্ডটারই একটা উইং। বরং এখানের প্রেজেন্টেশনে ডিটেইলিঙ অনেক বেশি।
কথাটা কি একটু জোরে হয়ে গেছিল? হঠাৎ পেশোয়া সরাসরি তাকালেন ওদের দিকে। সে দৃষ্টিতে কী ছিল? আভিজাত্য? ... ঘৃণা ?.... নাকি জিঘাংসা?.
...
স্বস্তিক পেছন থেকে সার্থকের জামা ধরে টানে ।
-চল নীচে যাবি?
সার্থকও এই পিছুটানে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।
-হ্যাঁ হ্যাঁ, চ দেখি ....
ঐ সাঙ্ঘাতিক দৃষ্টির সম্মোহন থেকে বেরিয়ে এসে দুজনেই বুক ভরে নি:শ্বাস নেয়। স্বস্তিক হাসতে হাসতে বলে,
-স্কুলে পড়া বাংলাটা তাহলে ভালোই ঝালানো গেল কি বল ?
সার্থক তার সাথে গলা মিলিয়ে হেসে ওঠে প্রাণ খুলে। কিন্তু সাথে সাথেই সে হাসি মাঝপথেই আচমকা বন্ধ হয়ে দম আটকে যাওয়ার মত অবস্থায় দুজনেরই গলা নয় বোধহয় নাভি থেকে বেরিয়ে ব্রহ্মরন্ধ্র ছুঁয়ে বেরিয়ে আসে ভয়ের হিঁ---ই----ই---- ধ্বনি।
কেন?
হ্ঠাৎ কি যেন দেখে ওরা দুপাশে ফুলের কেয়ারী করা ঘোরানো রাস্তা দিয়ে ছুটতে ছুটতে এসে দেখল বিশাল প্রধান দরজার মধ্যে যে একটা ছোট দরজা দিয়ে যাওয়া-আসা চলে সেটি আটেকাটে বন্ধ।
ওদের মাথার মধ্যে নিমেষে ওলটপালট ঘটে যায় । পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকে বেভুল দৃষ্টিতে । হঠাৎ স্বস্তিক মোবাইল বার করে চীৎকার করে ওঠে।
-এ কী রে! এগারোটা চল্লিশ!
সার্থক কোন উত্তর না দিয়ে আগে নিজের মোবাইল অন করে । বলে,
-কিন্তু আমরা তো ওখানে লাইট এন্ড সাউন্ড দেখছিলাম।
- সে শোটাই তো নটার মধ্যে শেষ হয়ে গেট বন্ধ হয়।
সার্থক চকিতে উপরে নিজামখানার দিকে তাকিয়ে দেখে- একি!! কোথায় কি? একদম তো ঘুটঘুটে অন্ধকার! ওরা যে তাহলে এতক্ষণ ওখানে ঝলমলে রাজসভা দেখছিল? কোথায় গেলে সে সব?
স্বস্তিক আর সার্থক ভাই এর থেকে বন্ধু বেশি। কিন্তু এই বিপদের মধ্যে কী করে যেন সার্থকের বোধহয় মনে হল ভাইটা তার ঘাবড়ে যায়নি তো? তাই ওর পিঠে হাত রেখে বলে ওঠে,
-ভয় পাস না সুশি। ওরা বুঝতে পারেনি আর কি। চল দরজায় গিয়ে ধাক্কা মারি । বাইরে সিকিওরিটি গার্ড আছে, খুলে দেবে।
-ভাইয়া, আপলোগ ক্যয়া আটক গ্যেয়ে?
কে? !! এ? !!
Comments