চতুর্থ পর্ব
ওরা চমকে তাকিয়ে দেখে এক সুন্দর চেহারার তরুন ফোয়ারার দিক থেকে ওদের দিকেই এগিয়ে আসছে। বোধহয় সিকিউরিটি গার্ড হবে। কারণ পরনে সেরকমই পোশাক। তবু
এতক্ষণে ওদের ধড়ে প্রাণ এল। বাব্বা: ওরা ছাড়াও কেল্লার ভিতরে আরও কেউ আছে তাহলে!
-আরে আমরা তো....
-রুকিয়ে রুকিয়ে ভাউ ( দাদা ), হমলোগ তো মরাঠি হ্যায়, লেকিন মালা সমঝলা (আমি ভাবলাম) কি আপলোগ বাহারওয়ালে হ্যায়। ইসলিয়ে হিন্দিমে আ গ্যেয়ে। মালা ইত্তার ভাষা সমঝু শকত নাহি । (আমি অন্য্ ভাষা বুঝতে পারি না।)
এরপর মরাঠি আর হিন্দীর জগঝম্পে যা বোঝা গেল তা বাংলায তর্জমা করলে দাঁড়ায়,
-আপনারা এমনভাবে আটকে পড়লেন কি করে দাদা, দুষ্টুমি করে লুকিয়ে ছিলেন বুঝি?
সার্থক আর স্বস্তিক নিজেদের এখন যা মনে করে তাতে দুষ্টুমি কথাটা কোনমতেই ওদের সাথে যায় না। তাই স্বস্তিকের ছোট্ট প্রশ্ন এল,
-কেন?
গার্ডটিও বোধহয় ওদের অস্বস্তিটা বুঝতে পেরেছিল। তাই তাড়াতাড়ি সেরে নেয়,
-না না ঐ ভুত দেখবার জন্য অনেকে ইচ্ছে করে থেকে যায় না তাই আর কি
-ভুত? হ্যাঁ নেটে এরকমই কিছু একটা পড়ছিলাম বটে। কিন্তু ভাল করে আর......
-কিন্তু সুশি, এখানেই কি গল্প করে রাত কাটিয়ে দিবি ? আমদের তো গিয়ে দরজা খোলাতে হবে নাকি? এরপর গার্ডরাও ঘুমিয়ে পড়লে কি হবে বলত?
সাথে সাথে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ে স্বস্তিক। গার্ডের পিঠে হাত রেখে বলে,
-দেখো ভাই, গল্প পরে হবে । আগে আমদের এই কেল্লা থেকে বেরতে সাহায্য করো তো।
-লেকিন ও দরওয়াজা আচ্ছা নেহি হ্যায়। উধর মৎ যাইয়ে ।
বলতে বলতে সে আচ্ছন্নের মত কেল্লার ভিতরের দিকে হাঁটতে শুরু করে দেয়।
ভাষার কিছু অসুবিধা থাকলেও এমন সুন্দর একটা ছেলের সঙ্গে কথা বলে দুই ভাইয়ের ভয় তখন অনেকটাই কেটে গেছে । তাই ভূতের গল্পের লোভে ওরাও গার্ডের অনুসরণ করে । ইতিহাসের সাক্ষ্য বহনকারী সেই বিশাল নি:ঝুম কেল্লা, মাঝরাতের হিমেল হাওয়া, আকাশের পরিপূর্ণ চাঁদ—এ সবকিছুই গল্পের আবহ তৈরী করে । ভিজে ঘাসের উপর জুত করে বসে পকেট থেকে ক্যাডবেরি বার করে দুজনে। কিন্তু গার্ড ছেলেটিকে দিতে গেলে সে যেন তা দেখতেই পায় না। তার চোখে তখন কোন সুদূর অতীতের ছায়া ঘনিয়ে এসেছে । কেমন এক ঘোরের মধ্যে থেকেই সে বলে যায়,
মারাঠা রাজকাহিনীর মধ্যে যেমন আদর্শ খুঁজে পাওয়া যায় তেমনই এক অদ্ভুত বীরত্ব প্রতিটা যুদ্ধের ইতিহাসে যেন শানিত তরবারির মতই ঝলসে ওঠে।
- তার মানে কি বলতে চাইছ একটা unique quality স্বস্তিক তড়বড়িয়ে বলে।
এতক্ষণে বোধহয় ছেলেটির ঘোর একটু কেটেছে। তাই হয়ত ভালো করে না বুঝেই বলে দেয়,
-হো ( হ্যাঁ )।
স্বস্তিক আর সপ্তকের কথাও কি একটু ভাবে? তাই এতক্ষণ পরে হলেও ওদের বলে,
-ভাউ , বসা। ( দাদা, বস ) ।
ওরা বসার পরে আবারও কেমন ঘোর ঘোর গলাতেই বলতে থাকে ছেলেটি ,
-শিবাজী প্রতিজ্ঞা করেছিলেন শিবের নামে যে, যতক্ষণ না মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবকে হারাতে পারছেন ততক্ষণ না নিজেও শান্তিতে বসবেন না শত্রুদেরও বসতে দেবেন না।
এবার বোধহয় সার্থকের বাধা দেওয়ার পালা,
- কিন্তু তিনি তো মহারাষ্ট্র এবং কর্নাটকের বিশাল অংশ দখল করেছিলেন।
এবার ছেলেটি যেই বলেছে,
-তাঁর ছেলে শাহুজির প্রধানমন্ত্রী বালাজি বিশ্বনাথ।
সাথে সাথে শুরু হয়ে যায় স্বস্তিক। আজ শনিবারওয়াড়া দেখতে আসার সময় তারা রীতিমতো পড়াশোনা করে এসেছে।
-প্রথম স্বাধীন পেশোয়া বালাজী বিশ্বনাথ পেশোয়াতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর ছেলে বিখ্যাত বালাজী বাজীরাও .......
কথা শেষ করতে না দিয়েই ছেলেটি বলে,
-পেশোয়া বাজীরাও বল্লার।
চুপচাপ কেটে যায় অনেকটা সময়। আবার যেন ঘনিয়ে আসে হিমেল হাওয়া, গাছেরা ওঠে শিরশিরিয়ে, চারদিক থেকে চেপে আসে রাতের অটুট অন্ধকার! তার মধ্যে যেন কোন অতল অন্যমনস্কতা থেকে ফের সে বলতে থাকে,
-মহারাজজী সাসড় আর পুণে- দুজায়গা থেকেই রাজকার্য চালাতেন। মারাঠারাজ শাহুর রাজধানী ছিল সাতারায়। কিন্তু বাজীরাও পুনেতেই শিবাজির জন্মস্থান লালমহলের কাছে একটা জায়গা খুঁজে নিয়ে ভাই চিমনজি আপ্পার সাহায্যে এই শনিবারওয়াড়ার প্রতিষ্ঠা করেন।
সার্থক হঠাৎ ক্লাসে পড়া বলবার মত করে তার নেটীয় বিদ্যে ঝেড়ে দেয়,
-হ্যাঁ, দশই জানুয়ারি সতেরশো তিরিশ-এ ভিত্তিস্থাপন আর বাইশে জানুয়ারি সতেরশো বত্রিশ্-এ বাস্তুশান্তি।
আচমকা এই কথাতেও ছেলেটির আচ্ছন্নতা কাটে না। স্বপ্নালু চোখে সে শুধু বলেই চলে,
-একসময় বাজীরাও -এর জীবনে আসে মস্তানি। বজীরাও -এর প্রথম পত্নী কাশীবাঈ,মা রাধা বাঈ, ভাই চিমনজি আপ্পা এবং প্রথম পুত্র নানা সাহেব তথা পুরো পরিবার মস্তানিকে বাজিরাওর দ্বিতীয় পত্নী হিসাবে মেনে নেয় নি। তাই তৈরী হল আয়না মহল, তৈরী হল মস্তানি দরওয়াজা। এরপরও এখানে অনেক মহল তৈরী হয়। বাজীরাও, নানা সাহেব, রঘুনাথ রাও, বিশোয়াস রাও, মাধব রাও, নারায়ণ রাও, দ্বিতীয় মাধব রাও- প্রত্যেকেরই জীবন এখানে কাটে। পরিবারের প্রয়োজনে ধীরে ধীরে তৈরী হল- স্নানশালা, ভোজনশালা, ঔষধভাণ্ডার, গোশালা ইত্যাদি । হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বলে,
-ও দেখো উঁহা থে গনেশ-উৎসব কা মহল।
আরও বলে চলে---এখান থেকেই সর্দার, উকিল সবার দেখাশোনা করা হত। একসময় তো পুরো মারাঠা সাম্রাজ্যটাই এখান থেকে নিয়ন্ত্রিত হত।
-কিন্তু এমনভাবে পুড়ে গেল কি করে এতবড় কেল্লাটা?
স্বস্তিক হঠাৎ জানতে চায়।
না এর কোন কারণ ছেলেটি বলতে পারে না। শুধু বলে নারায়ণ রাওএর হত্যার অনেক বছর পরে কোন এক অজ্ঞাত কারনে লেগে যাওয়া আগুনে সাত দিন ধরে জ্বলেছিল এতবড় কেল্লাটা । জানেন তো ভাউ ( দাদা ), এ কিল্লারই হয়ত রাগ হয়েছিল। সিংহাসনের লোভ করেই শনিবারওয়াড়া ধ্বংস হয়ে গেছে। রাগের আগুনে শত্রুদের পোড়াতে না পেরে নিজেকেই দিয়েছে পুড়িয়ে।
-আচ্ছা মনে হচ্ছে তুমি সবকিছু যেন একেবারে চোখের সামনে দেখেছ। তা তুমি বলতে পারবে কিসের রাগ? লোভই বা কিসের?
-হো ( হ্যাঁ )। নানা সাহেবের ছোট ছেলে নারায়ণ রাও পেশোয়া পরিবারের সন্তান হলেও তাঁর পেশোয়া হবার ইচ্ছা কোন দিনও জন্মায় নি।
নানা সাহেব মারা যেতে নিয়মমত বড়োছেলে বিশোয়াস রাও পেশোয়া হলেন। কাকা রঘুনাথ রাও প্রথম থেকেই তাঁর এই ভাইপোটিকে মোটেই সুনজরে দেখতেন না। তাঁর কেবলই মনে হত- এ হল ভবিষ্যতের পেশোয়া। তাই বিশোয়াস রাও অভিষিক্ত হবার পর থেকেই তিনি তার ক্ষতি করার চেষ্টা করছিলেন। শেষপর্যন্ত পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে প্রাণ গেল বিশোয়াসের। মেজো ভাইপো মাধবরাওকে রঘুনাথ কিছুটা হলেও প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন। কিন্ত দাদার মৃত্যুতে কেটে গেল সে প্রভাবের রেশ। এই মৃত্যুর জন্য নিজেকেই দায়ী মনে করে আত্মহননের পথ বেছে নেন মাধবরাও।
এইবার রঘুনাথের সামনে এল চরম সংকটের সময়। নানা সাহেবের ছেলেদের মধ্যে ছোট নারায়ণরাওকেই রঘুনাথ তাঁর অন্তরের সমস্ত স্নেহ উজাড় করে দিয়েছিলেন। কারণ একটাই- জানতেন সে কোনদিন পেশোয়া হবে না। এই ভালবাসা অবশ্য স্ত্রী আনন্দীবাঈ কোনদিনই ভাল চোখে দেখেননি । আবার নারায়ণ রাও বাবাকে বেশিদিন না পেয়ে কাকাকেই ভরসা করতেন বেশি। তাঁর যুদ্ধবিদ্যায় বীরত্বের পাঠ যতটা হয়েছিল দুনিয়াদারির পাঠ বোধহয় একেবারেই হয় নি। তাই তো তিনশ বছর ধরে সে কেঁদে কেঁদে ফিরছে.......
-হ্যাঁ!! হ্যাঁ!! ...... কি বললে??
ওদের এই ভীষণ চমককে আগ্রহ্য করেই বলতে থাকে,
-এবারও যখন তিনি পেশোয়া হয়ে গেলেন এতটাই কম বয়সে তখন কাকার স্নেহ বদলে গেল হিংসায়। ইন্ধন জোগালেন আনন্দীবাঈ । নারায়ণকে পরামর্শ দিলেন তথাকথিত শুভচিন্ত্কেরা। অভিভাবকহীন সতের বছরের পেশোয়া বুঝবেন কি করে ষড়যন্ত্রের গভীরতা। রীতিমত দিশেহারা হয়ে শেষপর্যন্ত কাকাকেই নিজের ঘরে নজরবন্দী করে ফেললেন তিনি। ব্যস্ সুযোগ পেয়ে গেলেন কাকী । পেশাদার খুনি লাগালেন নারায়ণ রাওকে মারতে । তবু শেষমুহূর্ত পর্যন্ত নারায়ণের ভরসা ছিল কাকা নিশ্চয়ই তাকে মরতে দেবেনা।
তারপর এল সেই ভয়ানক রাত। নারায়ণ রাওকে কিছুমাত্র জানতে না দিয়ে ঘাতকেরা ঘিরে ফেলল মহল। ঘন হয়ে এল তাদের চক্রান্তে। সে যেন মুখের কথায় নয়, খালি চুপচাপি আর ইশারায় অস্ত্র শানাল কেল্লার অলিন্দে অলিন্দে। আনন্দী বাঈ-এর লোকেরা বুঝি সেদিন রঘুনাথ রাওকেও রেখেছিল নিয়ন্ত্রণে! সত্যি কেমন সে ষড়যন্ত্র?
Comments