পঞ্চম পর্ব
এতক্ষণের গল্প শোনায় সার্থক আর স্বস্তিক দুজনেই একাত্ম হয়ে গিয়েছিল গার্ড ছেলেটির সাথে। তাই গভীর দু:খের সঙ্গে ষড়যন্ত্রের কথা বলতে বলতে সে চুপ করে যেতেই এদেরও মুখে আর কথা ফোটে না। যেন কত যুগের ওপার থেকে কোন এক অসহায় বালক, যার বাবা- দাদারা কেউ বেঁচে নেই, যাকে ঘিরে রেখেছে কিছু কুটিল ষড়যন্ত্রকারী. মা এবং স্ত্রী গঙ্গাবাঈ নিতান্ত উপায়হীনা হয়ে ভাগ্যের মুখাপেক্ষী হয়ে দিন গুণছেন। কালের আস্তর পড়ে ধুসর হয়ে যাওয়া তার করুণ কাহিনী সকলকেই একসাথে চুপ করিয়ে রেখে দিল অনেক অনেকক্ষণ। এবার গার্ড ছেলেটি আস্তে আস্তে মুখ তুলতেই দুজনে একযোগে প্রশ্ন করে,
-কি কি হল তারপর?
ছেলেটি কিন্তু যেন শুনতেই পেল না প্রশ্নটা, নিজের সাথে নিজেই বলে চলল,
-জানেন ভাউ, একের পর এক পেশোয়া পরিবর্তন হলে কি হবে পেশোয়া রাজ্যের তখন রমরম অব্স্থা। কিন্তু চার দরওয়াজা দিয়ে যেখানে এতদিন শুধুই সমৃদ্ধি ঢুকছিল, আজ সেখানে এত মুসিবত এল কোথা থেকে? না, গনেশ দরওয়াজা দিয়ে তো নয়। গনেশজি তো স্বয়ং সিদ্ধি আর বুদ্ধি নিয়ে বসেছিলেন সেখানে আশীর্বাদ করার জন্য। শায়দ মাস্তানি দরওয়াজা দিয়েই ঢুকেছিল কালসময়। সে এক দুর্দিন ঘনিয়ে এসেছিল পেশোয়া রাজপরিবারে।
- কিন্তু কেন, কেন এই কালসময়? ওদের আগ্রহ যেন আর বাধা মানতে চাইছে না।
-এবার যেন একটু ভাবনায় পড়ে যায় ছেলেটা। কিন্তু পরক্ষণেই বলে ওঠে,
-ও মাস্তানি বাঈ।
-কেন কেন? সে আবার কী করল?
- করবে আর কী? সে তো যুদ্ধ ছাড়া কিছুই করে নি। বাহার-অন্দর চারোতরফ। তাকে এত অপমান, তার জন্য এত সাজিশ .......
সে সব কাল হয়ে বরসাল ( বর্ষিত হল ) .... পর পর পেশোয়া-পদের লোকেরাই বা কেন চলে যাবে বোলো ভাউ?
ও যো বাজীরাও বল্লার না......
হ্যাঁ হ্যাঁ তিনি তো পেশোয়াদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত।
তাঁর তো জন্মের আগেই ভবিষবাণী হল কি দেশের ভাগ্য তিনিই বদলাবেন। তো বদল হল। কিন্ত যাচাই করতেন সবই। চলতেন নিয়মের উল্টোপথে। আর এভাবে যুদ্ধের মধ্যে দিয়েই ভালবাসলেন বুন্দেলখন্ডী ছত্রশালের মেয়ে মাস্তানিবাঈকে। ঘরে তখন বিবাহিতা স্ত্রী কাশীবাঈ।
স্বস্তিক আর সার্থক এতক্ষণ শুনতে শুনতে যেন সেই ইতিহাসের সময় থেকেই বলে ওঠে,
-কিন্তু মাস্তানি বাঈ-এর মা রুহানী বেগম।
- হাঁ ওহি তো কারণ। মুসলমানী। খানদানী ব্রাহ্মণ পরিবারে আপন হলেন না মাস্তানি বাঈ। বাজীরাও না ছাড়লেন পরিবার, না পত্নী কাশীবাঈ, না ভি মস্তানিবাঈ। আর এই টানামারিতে মাস্তানির যে লড়াই চলল, তা শেষ হল মৃত্যুতে। থোরালে বাজীরাও- ও তখন বীরগতি লাভ করেছেন।
-থোরালে! মনে? .......
- জ্যেষ্ঠ... জ্যেষ্ঠ..... প্রথম ...... প্রথম বাজীরাও ....... বলতে বলতে আবার যেন ঘোরের ভিতর চলে যায় সেই গার্ড ছেলেটি। তাকে তো এখন রীতিমতো গাইড বলে মনে হচ্ছিল যে অত বছরের পুরানো কথা সব এমনভাবে বলছে যেন সমস্ত কিছু সে নিজের চোখে দেখেছে। শুধু তাই নয় সার্থক আর স্বস্তিককেও সে ইতিহাসের দরজা খুলে নিয়ে গিয়ে হাজির করেছে সেই অঘটন- ঘটন- সময়ে। ফের সে গল্পের খেই ধরে নেয়,
-কোই শোচে কি যে ব্রাহ্মণ পরিবার বীর পেশোয়াদের জন্ম দিল সেখানে বিধর্মী রানী আসায় আনাচার হল।
সার্থক এবার আর থাকতে না পেরে বলে উঠলো,
-কিন্তু ভাই, আবার এমনভাবেও তো ভাবতে পারো যে, যাদের উপর সারা দেশের সুখদু:খের ভার, তারাই যদি মানুষের অবমাননা করে তবে কি পাপ হয় না?
- ও ভি তো সহি । কিন্তু কিসে যে আনাচার হল!! এত অপমান এত সংঘর্ষ এত অশান্তি...... শনিবারওয়াড়া হয়ে উঠল হত্যাপুরী। তো ওহি বাত ....... নানা সায়েবের পর বিশোয়াস রাও আর মাধবরাও এই কাল সময়ের শিকার হলেন। শিকার রঘুনাথ রাও-ও। কাল তাঁর ভিতরেই ঢুকে গেছিল। নাহলে তিনি নিজের পুতন্যা ( ভাইপো ) দের বিরুদ্ধে এমন চক্রান্ত করলেন? তাঁর হিংসার শাসন কেউ মানেনি। ও যো তিলেকর ভাউ অর বালক নারায়ণ রাও পেশোয়া .......... আনন্দী বাঈ সেদিন কালসাপের মত .......
কিন্তু নারায়ন তাঁর নিজের রক্ত ....... কাকা ....... কাকা আগর বচাতে ....
...
এসব বলতে বলতে কেমন যেন টলতে থাকে ছেলেটি।
ওকি! ওকি! অমন করছ কেন? ছেলেটিকে এবার যেন অচেনা লাগে ওদের। গল্প মাঝপথে গুলিয়ে যায় দেখে চেঁচিয়ে ওঠে স্বস্তিক,
- কি হলো সেদিন তারপর? কাকা তাকে বাঁচাল এসে?
-নেহি। উসদিন কাকী নে মুঝে মার ডালি, মুঝে মার ডালি-ই-ই-ই !!! পর কাকা বচানে নহী আএ।
মানে!!!
আচমকা ওর দিকে তাকিয়ে দেখে কোথায় গার্ড, এ তো এক পেশোয়া!! মাথার পাগড়ি, চুল, ঘাড় দিয়ে বীভৎস ভাবে রক্ত ঝরে পড়ছে। এর সাথেই চারিদিকের নৈ:শব্দ, রাতচরা পাখির ডাক, এলোমেলো হাওয়ায গাছেদের উথালিপাথালি সব যেন এতক্ষণে কথা বলে ওঠে। ওদের নিয়ে যায় সেই যুগের সেই দিনে। ওদের সারা শরীর বেয়ে যেন হিমেল স্রোত নামতে থাকে।
হঠাৎ চীৎকার করে কান্নায় ভেঙে পড়ে বলে,
-উয়ো দেখ গর্দি শিকারীয়োঁ লোকর আলা ( ছুটে আসছে ) মুঝে মার ডালেগা। ও দেখ গোমাতা কি হত্যা হো রহা হ্যায়।
স্বস্তিক কোনরকমে বলে,
-এ-এ-এ তুমি?
কালো পোশাক পরা কিছু ছায়াশরীরে ভরে যায় বাগিচা একা অসহায় ছেলেটা ওদের মাঝে পড়ে শুধু আর্ত চীৎকারে যেন ভরিয়ে তোলে রাতের আঁধারকে। বারান্দার উপর দেখা গেল এক বর্ষিয়সীকে। স্বস্তিক ভয় ভুলে চেঁচিয়ে উঠল- পার্বতীবাঈ ( নেটে পড়েছিল যে)। আবার ছুটে আসে ওরা ওই ছেলের পিছনে। ওরা ওদের সমস্ত ভয় ভুলে নিশিতে পাওয়া মানুষের মতো ছুটতে থাকে ওর পিছনে। ওদিকে কি মন্দির? ছেলেটা ‘কাকা’ ডাকতে ডাকতে ছুটে চলেছে যে! তবে কি ইনিই রঘুনাথ রাও? ছেলেটা তাঁর পা জড়িয়ে মারাঠী ভাষায় কি বলছে। ‘পেশোয়া’ শব্দটা কয়েকবার শোনা গেল। সিংহাসন দেবার কথা বলছে কি? কিন্তু না, হাত ধরে তাকে টেনে তুলে দুজনে মিলে ধরে আনতে থাকে। চীৎকারে কাঁপতে থাকে আকাশ বাতাস,
-ইয়ে দেখো তুলাজি অর সুমেরসিং। অব কেয়া হোগা .......... কাকা মালা বাচাবা .........
প্রায় দশ এগারো জনের মাটিতে ফেলে হত্যাকাণ্ড দেখল ওরা সেখানে দাঁড়িয়েই। তর মধ্যে পৈতাধারী পুরোহিত, ভৃত্য এমনকি দুজন দাসীকেও দেখা গেল।
হঠাৎ আবার পলকের মধ্যেই মিলিয়ে যায় সেই বাহিনী। কেবল জেগে থাকে সেই কাতর আর্তি,
-এতদিন ধরে আমি জ্বলছি জ্বলছি। দুর্গে আগুন লাগল। ও দেখ দরবার, মন্দির দরোয়াজা সব কিছুতে আগুন আগুন....... কাকা মালা বাচাবা; কাকা মালা বাচাবা.......
বলতে বলতে ছুটতে থাকে সেই অসহায় তরুন।
ওরা আর পারে না। সারা পৃথিবী যেন ভৌতিক হয়ে উঠেছে। ওরা প্রাণপণে দৌড়ে গিয়ে প্রধান ফটকের বন্ধ দরজায় পাগলের মত আঘাত করতে থাকে। এবার একজন সত্যিকারের সিকিউরিটি গার্ড এসে দরজা খোলে। ওদের আর কিছু মনে নেই।
জ্ঞান হওয়ার পর ওদের কথা শুনে সিকিউরিটি গার্ডেরা বিশেষ বিচলিত হয়নি, কারণ এমন ঘটনা তো আগেও বহুবার ঘটেছে। আর তাই জন্যই তো এত সতর্কতা। ওদের কাছে ওরা আবার ইতিহাসের কিছু কিছু কথা শোনে কিন্তু আসল ঘটনা তো ওরা কাল রাতেই শুনেছে ছেলেটি ( ?? ) নারায়ণ রাও- এর মুখে। দেখেছে অনেক কিছু চোখের সামনে! ওদের চোখের সামনে থেকে শহর, কেল্লা, যা কিছু দেখেছে- সে সমস্ত জাঁকজমক, রাজদরবার সব কিছু মুছে যায়। সার্থক অন্যের কান বাঁচিয়ে নিচু গলায় স্বস্তিককে বলে,
কত ছেলেমানুষ বল? সকলেই তো চলে গেছে কেল্লা ছেড়ে, কালের নিয়মে। থেকে গেছে শুধু ও-ই .......
এত মায়া!!
স্বস্তিক তেমনই যেন নিজের মনেই বলে,
আসলে ভুলতে পারেনি কিছুই। মনের আগুন কি ওর নিভবে কোনদিন? সেই দিনটা মনের মধ্যে চিরদিন জেগে আছে। যেদিন তার ভরসা, বিশ্বাস আর পরম্পরার হত্যা হয়েছিল।
সার্থক বলে,
দেখ, কেউ মারা গেলেই তো বলি আত্মার শান্তি হোক, কিন্তু এবার যেন মন থেকে প্রার্থনা করছি ওই অশান্ত আত্মার এত যুগের এত কষ্টের এত অভিমানের সফর শেষ হোক। এবার যেন সে শান্তি পায়। এতকাল ধরে ছুটে আসা শিকারীদের হাত থেকে সত্যিই বাঁচতে পারে।
সার্থক স্বস্তিকের সঙ্গে সঙ্গে আমিও ফিরে গেছিলাম সেই যুগে। কি ভয়ংকর হত্যালীলা সংঘটিত হয়েছিল সেই কালরাত্রিটিতে ।ইতিহাস বড়ো নির্মম। নারায়নরাও এর আত্মা শান্তি পাক এই প্রার্থনা করি